শিশুখাদ্য নেসলের সেরেলাক নিয়ে ভয়ংকর তথ্য

বিশ্বের বৃহত্তম খাদ্যদ্রব্য প্রক্রিয়াজাতকারী সুইস কোম্পানি নেসলের বাংলাদেশে শিশুখাদ্য হিসেবে সর্বাধিক বিক্রিত দুটি পণ্য— সেরেলাক এবং নিডোতে উচ্চ-মাত্রার চিনির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। যদিও যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড এবং অন্যান্য উন্নত দেশে নেসলের বিক্রি করা একই শিশুখাদ্যে কোনও ধরনের বাড়তি চিনি যুক্ত করা হয় না। শিশুদের খাবারে চিনি যুক্ত না করার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশ রয়েছে। কারণ শিশুখাদ্যে চিনি যুক্ত করা হলে তা স্থূলতা এবং দীর্ঘস্থায়ী কয়েকটি রোগের কারণ হতে পারে।

সুইজারল্যান্ড-ভিত্তিক অলাভজনক বেসরকারি সংস্থা পাবলিক আই ও ইন্টারন্যাশনাল বেবি ফুড অ্যাকশন নেটওয়ার্কের নেসলের শিশুখাদ্য সেরেলাক ও নিডো নিয়ে করা গবেষণায় মিলেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাদের যৌথ গবেষণায় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিক্রি করা নেসলের এই দুই শিশুখাদ্যে উচ্চ-মাত্রায় চিনি যুক্ত করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

পাবলিক আইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্য কোম্পানি নেসলে বেশ কয়েকটি দেশে শিশুদের জন্য তৈরি করা দুধ ও সিরিয়াল পণ্যগুলোতে বাড়তি চিনি ও মধু যুক্ত করে। যা স্থূলতা এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধের আন্তর্জাতিক নীতিমালার লঙ্ঘন।

নেসলের শিশুখাদ্যে বাড়তি চিনি যুক্ত করার আইন লঙ্ঘনের এই ঘটনা কেবল এশিয়ান, আফ্রিকান এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে পাওয়া গেছে। গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। নেসলের শিশুখাদ্য পণ্যের বিষয়ে ওঠা অভিযোগের তদন্ত করছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বলেছে, গবেষণায় পাওয়া ফলাফল একটি বৈজ্ঞানিক প্যানেলের সামনে উপস্থাপন করা হবে।

বাংলাদেশে নেসলের শিশুখাদ্য সেরেলাক থেকে একজন শিশুকে একবার যে পরিমাণ খাবার পরিবেশন করা হয়, তাতে প্রায় ৩ দশমিক ৩ গ্রাম বাড়তি চিনি থাকে

পাবলিক আই বলছে, নেসলে সুইজারল্যান্ডে বাজারজাত করা তাদের পণ্য সেরেলাকে বাড়তি কোনও চিনি ব্যবহার করে না। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোতে সেরেলাকে বাড়তি চিনি যুক্ত করে তারা।

মধ্য-আমেরিকার বেশিরভাগ দেশে ইনফ্লুয়েন্সারদের ব্যবহার করে নিডোর আক্রমণাত্মক প্রচার চালায় নেসলে। ওই অঞ্চলে এক বছর বা তার বেশি বয়সী বাচ্চাদের জন্য বাজারজাত করা ফর্মুলায় একটি শিশুকে সাধারণভাবে একবার যে পরিমাণ খাবার দেওয়া হয় তাতে চিনির পরিমাণ অনেক বেশি।

বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, সেনেগাল এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতেও নিডো ব্যাপক জনপ্রিয়। এসব দেশেও এক থেকে তিন বছর বয়সী ছোট বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা নেসলের সব পণ্যে বাড়তি চিনি রয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে নেসলের ৯টি খাদ্যপণ্য বিক্রি করা হয়। আর এসব পণ্যের প্রত্যেকটিতেই বাড়তি চিনি রয়েছে। নেসলের এসব পণ্য থেকে একজন শিশুকে একবার যে পরিমাণ খাবার পরিবেশন করা হয়, তাতে প্রায় ৩ দশমিক ৩ গ্রাম বাড়তি চিনি থাকে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি নেসলে ইন্ডিয়ার একজন মুখপাত্রের সাথে এই বিষয়ে কথা বলেছে। ওই মুখপাত্র বলেছেন, তারা গত পাঁচ বছরে নেসলের শিশুখাদ্যে যোগ করা চিনির পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ কমিয়েছে। এছাড়া আরও কমিয়ে আনার বিষয়ে তারা পণ্যগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করছেন।

এক থেকে তিন বছর বয়সী ছোট বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা নেসলের সব পণ্যে বাড়তি চিনি রয়েছে।

বর্তমানে ভারতের বাজারে নেসলের ১৫টি পণ্য রয়েছে। এসব পণ্যের প্রত্যেকটিতেই বাড়তি চিনির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ভারতে বিক্রি করা নেসলের সব পণ্যে বাড়তি চিনির পরিমাণ গড়ে প্রায় ২ দশমিক ৭ গ্রাম। ওই মুখপাত্র বলেন, আমরা শৈশবকালের জন্য আমাদের পণ্যের পুষ্টির গুণমানে বিশ্বাস করি এবং উচ্চ-মানের উপাদান ব্যবহারে অগ্রাধিকার দিই।

গবেষণায় দেখা যায়, ভারতে নেসলের ১৫টি সেরেলাক শিশুখাদ্য থেকে একটি শিশুকে একবার যে পরিমাণ খাবার দেওয়া হয় তাতে গড়ে প্রায় ৩ গ্রাম চিনি থাকে। একই পণ্য জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যে বিক্রি করা হচ্ছে বাড়তি চিনি ছাড়াই। অন্যদিকে ইথিওপিয়া ও থাইল্যান্ডে এই চিনির পরিমাণ প্রায় ৬ গ্রাম।

বিশ্বে শিশুখাদ্যের এক নম্বর ও সর্বাধিক বিক্রিত পণ্য নেসলের সেরেলাক। ইউরোমনিটরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে নেসলের এই একটি শিশুখাদ্যের বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাবলিক আই বলেছে, আমরা নেসলের প্রধান বাজার আফ্রিকা, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকায় বিক্রি করা ১১৫টি পণ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। এর মধ্যে কমপক্ষে ১০৮টি (প্রায় ৯৪ শতাংশ) পণ্যে বাড়তি চিনি রয়েছে।

সুইস এই অলাভজনক সংস্থা বলেছে, আমরা এসব পণ্যের মধ্যে ৬৭টিতে বাড়তি চিনির পরিমাণ নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের বিশ্লেষণে একবার পরিবেশন করা খাবারে প্রায় ৪ গ্রাম বাড়তি চিনির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে নেসলের খাদ্যপণ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ চিনির উপস্থিতি পাওয়া গেছে ফিলিপাইনে। দেশটিতে একজন শিশুকে সাধারণভাবে একবার যে পরিমাণ খাবার দেওয়া হয়, তাতে গড়ে প্রায় ৭ দশমিক ৩ গ্রাম বাড়তি চিনি থাকে।

জোহানেসবার্গের উইটওয়াটারসরান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্যের অধ্যাপক ও শিশু বিশেষজ্ঞ কারেন হফম্যান বলেন, ‌আমি বুঝতে পারছি না কেন দক্ষিণ আফ্রিকায় বিক্রি করা পণ্য উচ্চ-আয়ের দেশগুলোতে বিক্রি হওয়া পণ্যের তুলনায় আলাদা হতে হবে।’’ তিনি বলেন, এটা ঔপনিবেশের একটি রূপ এবং এটা মেনে নেওয়া উচিত নয়। হফম্যান জোর দিয়ে বলেন, শিশুখাদ্যে বাড়তি চিনি যোগ করার বৈধ কোনও কারণ নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুখাদ্যে বাড়তি চিনি যুক্ত করাটা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং অপ্রয়োজনীয় চর্চা। ব্রাজিলের পারাইবা ফেডারেল ইউনিভার্সিটির পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও মহামারি বিশেষজ্ঞ রদ্রিগো ভিয়ান্না বলেন, এটা বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়। শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের খাবারে বাড়তি চিনি যুক্ত করা উচিত নয়। এটা অত্যন্ত অপ্রয়োজনীয়।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*